কেওক্রাডং হূদয়জুড়ে

কেওক্রাডং হূদয়জুড়ে

ছোটবেলায় বইপত্রে মুখস্থ করে এসেছি— বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া কেওক্রাডং, উচ্চতা ৩ হাজার ২৩৫ ফুট। তখন এগুলো নিতান্তই একটা নাম আর সংখ্যা। পড়ার সময় কখনো কি ভেবেছি, একদিন এই শৃঙ্গ সামিট করার সুযোগ হবে? কিন্তু সুযোগ এল, ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়েও পড়লাম। সঙ্গী ২২ জনের বিশাল ট্রেকার বাহিনী। রাতের বাসে রওনা হয়ে পরদিন সকালে বান্দরবান পৌঁছলাম। ঠিক হলো প্রথম দিন ট্রেক করে বগালেক যাওয়া হবে, সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে যাত্রা।

শহর থেকে জিপ নিয়ে রুমার উদ্দেশে রওনা হতে হতে ১২টা বেজে গেল। আমরা তিনজন জিপের ছাদে উঠে বসলাম, কড়া রোদে মুখ-চোখ ঝলসে যাচ্ছিল, কিন্তু তা ছাদে ওঠা থামানোর জন্য যথেষ্ট নয়। গাড়ি চলা শুরু করতেই ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেল। তারপর সেই চেনা রাস্তা ধরে চলা, দুই পাশে শত শত পাহাড়ের সারি, দূরে বিশাল চিম্বুক রেঞ্জ গভীর মমতায় ঘিরে আছে পুরো এলাকা। আগেও বহুবার এসেছি, তবু কিছুই পুরনো হয় না, প্রথম দেখার অনুভূতিতে শিহরিত হই বারবার। বেলা ৩টায় রুমা বাজার এসে থামলাম। আর্মি ক্যাম্পে চেক ইন করে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম ল্যান্ড ক্রুজার নিয়ে। কেননা নিরাপত্তাজনিত কারণে সাড়ে ৩টার পর এ এলাকা থেকে বগা লেকের উদ্দেশে কোনো গাড়ি বের হতে দেয়া হবে না। এখান থেকে গাড়িতে ১১ কিলোমিটার পর্যন্ত যাওয়া হবে। কিন্তু এই ১১ কিলোমিটার আসতে একেকজনের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। রাস্তা ভয়ঙ্কর খারাপ। কয়েক হাত কাদা পুরো রাস্তাজুড়ে। এর মাঝেই খাড়া রাস্তা বেয়ে উঠতে হচ্ছে, কখনো নামতে হচ্ছে। একটু বেশি কাত হলেই পাশের খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন বিকাল পড়ে এসেছে। এখানে সন্ধ্যা নেমে যায় আগে আগে। চারপাশে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। সবাই হাতে টর্চ নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। এ ঘুটঘুটে অন্ধকারেই ট্রেক করে যেতে হবে আরো আট কিলোমিটার। শেষে খাড়া একটা পাহাড়ের চূড়া বেয়ে উঠে তবে দেখা মিলবে বগা লেকের।

প্রথম পথটুকু নির্বিঘ্নেই পার হলাম। পথে অনেকগুলো পাড়ায় থেমে থেমে খাওয়া তো চলছিলই। পাহাড়ি কলা, পেঁপে, আখ— লোভ সামলানো মুশকিল। একসময় এসে থামলাম কমলাবাজার। এখান থেকে পাহাড় বেয়ে বাকি পথ যেতে হবে। হাতে লাঠি নিয়ে ওঠা শুরু করলাম। প্রথম ৫ মিনিট যেতে না যেতেই মনে হচ্ছিল ফুসফুস যেন ঠেলে বের হয়ে আসবে, অন্ধকারে সামনে পথ দেখতে পাচ্ছিলাম না বলে প্রথমে কারণ বুঝিনি। আসলে এ পথটা ভয়ঙ্কর রকম খাড়া। টানা হাঁটতে গেলে পা অবশ হয়ে যায়। সামনে-পেছনে কেউ নেই, এক-দুজন সামনে চলে গেছে, বাকিরা পেছনে। পা আর চলছে না। আর না পেরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। হাতের আলোটা নিভিয়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আকাশে যেন ১০০ ওয়াট বাল্বের মতো লাখ লাখ তারা জ্বলে উঠল। কোথাও কেউ নেই। বনের ভেতর থেকে একটানা কোনো পোকা ডেকে চলছে। দূরে আবছা আলোয় পাহাড়গুলোর অবয়ব ভেসে উঠেছে শুধু। আমি চুপ করে বসে পাহাড়ের গান শুনছি। বোধহয় কোনো ঘোরের ভেতর চলে গিয়েছিলাম। পেছনে পায়ের শব্দ পেতে আবার উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একসময় হাঁপাতে হাঁপাতে চূড়ায় পৌঁছলাম। সামনে একটা বিশাল লেক। এটাই বিখ্যাত বগা লেক। মৃত্যুকূপ নামে পরিচিত এ লেকের পানিতে নামা নিষেধ। তবু পাড়ে দাঁড়িয়ে গা ভিজিয়ে সিয়ামদির কটেজে খাওয়াদাওয়া শেষ করে গভীর রাতে লেকের সামনে পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে বসলাম। পাশেই আমাদের তাঁবু ফেলা হয়েছে। আমাদের গাইড বেলাল ভাই অচেনা এক অদ্ভুত মায়াবি সুরে গান ধরলেন। আঞ্চলিক টানের জন্য গানের কথাগুলো বুঝতে পারছিলাম না পুরোপুরি। শুধু মাঝে মাঝে ‘তুমি বিহনে… এ হূদয়জুড়ে কেওক্রাডং… মনে পড়ে’ কথাগুলো ভেসে আসছিল। চারপাশে কোনো আলো নেই। শুধু দূরে দিগন্তে অদ্ভুত একটা হালকা রুপালি আলো। তার বিপরীতে পাহাড়গুলো কালো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, পাহাড়গুলো থেকে গানের কথাগুলো ভেসে আসছে। রাতের আবহ বা সুরের জন্য হয়তোবা গানের কথাগুলো মাথায় গেঁথে গেল। বাকি ট্যুরে পুরোটা সময় এ কয়টা লাইনই শুধু গুন গুন করেছি।

কেওক্রাডং এর পথে

কেওক্রাডং এর পথে 

পরদিন সকালে উঠে সবাই প্রস্তুত হয়ে নিলাম। সকাল ১০টার মধ্যে বের হয়ে পড়লাম কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে। উঁচু-নিচু রাস্তা কখনো খাড়া হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে, কখনো নেমে যাচ্ছে। আমরাও সবাই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে গল্প করতে করতে এগোচ্ছি। ঘণ্টা দেড়েক পর পথে পড়ল চিংড়ি ঝরনা। ঝরনার পানিতে মনের সুখে লাফালাফি-দাপাদাপির পর ভেজা কাপড়েই আবার হাঁটা দিলাম। দুই পাশে পাহাড়ের সারি তো সঙ্গে আছেই।

টানা ২ ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা প্রথম দলটা কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় পা রাখলাম। ততক্ষণে বেলা পড়ে এসেছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর কাঁপছে। কিন্তু ওইদিকে কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। নির্বাক হয়ে সামনে তাকিয়ে দেখছি শুধু। যত দূর চোখ যায় নীলচে পাহাড়গুলো শুভ্র মেঘে নিজেকে আবৃত করে রেখেছে। প্রকৃতি এখানে খুব বিষণ্ন। অদ্ভুত ছেলেমানুষি অভিমানে বুক ভরে গেল। এ ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যকে বন্দি করা যায় না কেন?

লিখেছেনঃ ইশফাকুন নিসা |

সর্বাধিক পঠিত

সাম্প্রতিক

You have successfully subscribed to the newsletter

There was an error while trying to send your request. Please try again.

Living Art Style will use the information you provide on this form to be in touch with you and to provide updates and marketing.