স্বাস্থ্য কথন: করোনাকালীন অবসাদ (কারণ ও প্রতিকার)

স্বাস্থ্য কথন: করোনাকালীন অবসাদ (কারণ ও প্রতিকার)

এই করোনা মহামারী যেন আমাদেরকে শুধু শারীরিকভাবে না মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ করে দিচ্ছে। আমরা যারা এখনো করোনা আক্রান্ত হয়নি অবশ্যই আমরা এই ব্যাপারে কৃতজ্ঞ, কিন্তু সচেতনতার দরুন আমরা যে ডিপ্রেশনের দোরগোড়ায় পৌঁছিয়েছি তাও যেন ভাষায় বুঝিয়ে বলার বাইরে। এই মুহূর্তে যারা এই ডিপ্রেশনের শিকার হচ্ছেন বেশিরভাগই তরুণ সমাজ। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া তাদের যে সামাজিক যোগাযোগ তা ছিল তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে ট্যুর বা বন্ধুদের সাথে হ্যাংআউট করলেও যেন এই অবসাদের ঘোর থেকে কেউ বের হতে পারছিনা। কেন এমনটা? কারণ সেই বছরের শুরু অর্থাৎ মার্চ থেকেই কিন্তু আমরা বাসায়। এরকম এতটা বসে থেকে যেন একঘেয়েমি ভোর করেছে। আবার শিক্ষা ও চাকুরী কার্যক্রম সব ই অনলাইন ভিত্তিক হওয়ায় এসকল ডিভাইসের যান্ত্রিকতা ও মানব মস্তিষ্কে যেন হানা দিয়েছে। সৃজনশীল সব কিছু থেকে শুরু করে ডালগোনা কফির পালা-ও শেষ, এবার তবে উপায়? আজকে শুধু তরুণ সমাজকে নিয়ে বলবো অবসাদের কারণ ও উপায়, তো শুরু করা যাক-

কারণ-

১. আমরা তরুণ সমাজ বলতে চাকুরী তে ঢুকবে অর্থাৎ ইন্টারনশীপে আছে এরকম যুবক বা যুবতীকেই ধরছি। যারা এত বছর কিন্তু দৌড়া-দৌড়ির মধ্যে বড় হয়েছে। স্কুল থেকে ভার্সিটিতে যতো প্যারাই হোক বা চাপ এগুলা দেখে বা নিজের উপর নিয়ে অভ্যস্ত এই জেনারেশন। সেখানে এখন তাদের কিছুই করতে হচ্ছে না বড়জোর আলসেমি আরো জেঁকে বসেছে। কেননা আপনি ক্লাসে জয়েন দিয়ে মিউট করে কিন্তু ঘুমাতেও পারেন, ভার্চুয়াল দেখেই এটা সম্ভব। অর্থাৎ আপনার মস্তিষ্ক কিন্তু বলতে গেলে একদমই অলসের কারখানাতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। যেটা আপনার ভেতর অবসাদ আনছে, কেননা আপনি শারীরিক দৌড়াদৌড়ির মাধ্যমে চাপ অনুভব করলে তবেই অবসর সময় উপভোগ করতে পারবেন। নতুবা সব সময় একই রকম মনে হবে।

২.এতদিনে আমাদের বিভিন্ন ধরণের সৃজনশীলতাও ট্রাই করে শেষ। ছবি আঁকা, নাচ, গান গাওয়া,রান্না-বান্না, হ্যান্ডিক্রাফট বানানো ইত্যাদি অবাক কিছুই রপ্ত করা শেষ আমাদের। এখন আর কিছুই ভাল্লাগছে না, আর নতুন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। যেটা অবসাদের জন্য একটা ফাঁক-ফোকর হতে পারে।

৩. আমাদের কাজ-পড়াশুনা সব দরকারি ও প্রয়োজনীয় জিনিসই অনলাইন বা ডিভাইস ভিত্তিক। আপনি নিজেই খেয়াল করুন, অফলাইনে আপনি ডিভাইস ব্যবহার করতেন বড়জোর কল,চ্যাট বা ই-মেইল করতে। কিন্তু এখন করোনার দরুন কত নতুন কিছু সম্পর্কে জানছেন এবং আরো জড়িয়ে পড়ছেন এই যান্ত্রিক জীবনে। এই যান্ত্রিকতার প্রভাব বা ফলাফল যাই বলেন আমাদের জীবনে কিন্তু বিরূপ।

৪.বন্ধুদের সাথে আড্ডা, বিকেলে বের হওয়া, খেলাধুলার মর্ম এতদিনে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়! ভিডিও কল করে কখনোই সেই আগের অনুভূতিটি পাবেন না যেটা আমাদের ক্লাসের ফাঁকে রোজকার টঙের আড্ডায় মেতে উঠতো। এই সামাজিকতা গুলো বাদ পড়ায় যেন আরো অসামাজিক হয়ে গেছি আমরা।

৫.এই করোনায় কত মানুষ পারিবারিক দ্বন্দ্ব, অভাব বোধ, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি কঠিনতম সময় যেন ঘরে বসে এক একাই পার করছে। এরকম ভেঙে পড়া সময় গুলোতে কাউকে সশরীরে পাশে পাওয়া দূরে থাক, নিজে কোথাও গিয়ে যে মাইন্ড ডাইভার্ট করে আসবেন সেই উপায় ও নেই।

এগুলো ছাড়াও আরো অনেক কারণেই করোনা এবং এই লকডাউন আমাদের তরুণ সমাজকে খুব বাজে ভাবে প্রভাবিত করেছে। আর বছরের শেষের সাথে সাথে যেন উপায় চিন্তা করার শক্তি ও শেষের পথে। ঘরে বন্দি অবস্থায় থাকলেও এই বছরটা ছিল মানসিক ভাবে ক্লান্তিকর। তাই আমরা নিয়ে এসেছি বেশ কিছু উপায় যা আপনি নিজের দৈনিক জীবনে কিছুটা ট্রাই করতেই পারেন-

সমাধান-

১.প্রথমেই এই যান্ত্রিকতার উপর বিরক্তি ধরে গেলে কিছুটা সময় অবসর নিন। ফোন,ল্যাপটপ বা কোনো ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে প্রয়োজন না পড়লে দূরে থাকুন। এই সময়টা দিন নিজেকে। বই পড়ুন, ঘরে গাছ থাকলে পানি দিন, গাছের যত্ন নিন, পাড়ার পাখিগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করুন, হয়তো আলমারির কোন বেশ অনেকদিন আবার অগোছালো সেটি গুছিয়ে ফেলুন। এইরকম অনেক দিনের জমানো কাজ যা হয়তো আপনার চোখের ই সামনে এগুলো করে ফেলুন। দেখবেন ডিভাইস ছাড়াই যায়নি বেশ ব্যস্ত থাকতে পারছেন।

২.শরীরচর্চার উপর কোনো কথা হবেনা! আসে পাশে কাছে কোথাও মাস্ক পরে এবং নিরাপদ দূরত্বে হেঁটে আসতে পারেন। সকাল-বিকাল যখনই হোক। কিংবা ছাদে চলে যেতে পারেন, তাও যদি সম্ভব না হয় তবে বাসাতেই ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন। ইউটিউবে বা ফোনে এ্যাপ্স নামানো যায়। সেগুলো দেখতে পারেন। সেই অনুযায়ী নতুন বছরে নাহয় নিজেকে নতুন আঙ্গিকে দেখলেন।

৩.সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ভিন্নতা আনুন একঘেয়েমি কাটবে। একই জিনিস অনেকটা সময় জুড়ে না করে একেক সময় একেকটা করলেন। হতে পারে কোনো মুভি বা সিরিজ দেখার ঝোঁক আবার হতে পারে বইয়ের পোকা হবার নেশা। আবার নতুন রান্নার ভুতও মাথায় চাপতে পারে বা আজকে হয়তো কোন দৃশ্য এঁকে ফেলতে মন চাইলো রংতুলির আঁচড়ে। সেলাই, ঘরের কাজ, বাগানের যত্ন যেটাই হোক না কেন একেক সময় একেকটা কাজ করবেন একটা তে একঘেয়েমি আসলেই সেটি পাল্টে অন্য কোনো শখে মনোযোগ দিন দেখবেন অবসাদ কিভাবে ছুটি নেয়।

৪.অনেক তো ভিতরের শিল্পী কে প্রাধান্য দিলেন এবার নাহয় একটু বাস্তবতায় ফেরা যাক। কিরকম? এই যে ধরুন আপনার বন্ধুরা ট্যুরে যাচ্ছে বা কাছেই বাইরে কোথাও খেতে যাচ্ছে। ইচ্ছা আপনার থাকলেও হাতে সে পরিমান টাকা নেই। উপায় বের করুন। ঘরে বসে ডিভাইস কেন্দ্রিক জীবনের ফায়দা লুফে নিন। ফেসবুকে জব অপশন নামে নতুন ফিচার যুক্ত হয়েছে অনেক আগেই। আবাসন করতে পারবেন ফেসবুক বা মেইল থেকে আর করোনার দরুন ইন্টারভিউ ও হচ্ছে অনলাইনেই। বা বাসার আসে পাশেই কোনো প্রাইভেট বা টিউশন জোগাড় করে ফেলুন। দেখবেন এভাবে যেরকম নিজেও ব্যস্ত থাকছেন আবার মাস শেষে ইনকাম পাওয়ায় যে ভালো অনুভূতিটা কাজ করবে তা বলার বাইরে। আবার চাইলে যেকোনো সময়ই যোগ হতে পারবেন বন্ধুদের সাথে।

৫.নিজেকে গুরুত্ব দিন। এই বছরটা সবারই কমবেশি অনেক খারাপ গেছে। এইসময় নিজেকে ভালোবাসুন যত্ন নিন। ভাবছেন সেটা কিভাবে সম্ভব? হতে পারে রূপচর্চা বা মেডিটেশন, হতে পারে একটা ট্রিট নিজেকে নিজে দেওয়া বা পছন্দের কোনো জিনিস নিজেকে গিফট করা বা হতেই পারে অনাহারী, শীতার্তদের একটু সাহায্যের হাত বাইরে দেওয়া। মোদ্দা কথা, নিজের প্রিয় মানুষকে যেভাবে যত্ন নেন ঠিক সেভাবেই নিজেকে যত্ন নিতে শিখুন, আসেপাশের মানুষকে দেখে রাখুন এবং সেই সাথেএকটু মনের কথা শুনুন। নিজের এই দিকটা দেখে হয়তো নিজেরই তাক লেগে যেতে পারে আপনার।

নিজেকে নিজেরই মোটিভেট করতে হবে আগামীর কঠিন দিনগুলির জন্য, নিজেকে করতে হবে প্রস্তুত। সেই প্রস্তুতি ঘরে বসে মন খারাপ না করেই শুরু হোক না! নতুন বছরের রেসুলিউশন নাহয় এবার সত্যিই হলো। একটা গোল বেঁধে নিন যে এই সময়ের মধ্যে এই দিকটাতে আপনি উন্নতি করবেন। নিজেকে নিজে চ্যালেঞ্জের মুখে কারে দিন, তারপর দেখুন একবার জিতার অনুভূতি কীরকম। এই বছরটা আপনাকে বিরক্ত করে দিয়েছে এটা ঠিক, মানসিক অবস্থাও যায়-যায় কিন্তু আপনি সবার মাঝে সবার সাথে বেঁচে আছেন, অভাব বোধ করছেন না এটাও কি কম কৃতজ্ঞতার ব্যাপার। এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে পরিস্থিতিকে আপনার কন্ট্রোল নিতে দিয়েন না। বরং নিজে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নিন,গড়ে তুলুন নিজের উজ্জ্বল আগামী।

সাম্প্রতিক