সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ :আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল যেখানে মিলেমিশে একাকার

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ :আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল যেখানে মিলেমিশে একাকার

তীরে বাঁধা নৌকা, নান্দনিক নারিকেল বৃক্ষের সারি আর ঢেউয়ের ছন্দে মৃদু পবনের কোমল স্পর্শে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপের সৌন্দর্য  সম্ভব নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপ সামুদ্রিক জীবন সমৃদ্ধ। সবুজ শ্যামল বৃক্ষবেষ্টিত সাগর বুকে ভাসমান অনন্য শোভাময় সৌন্দর্যের প্রতীক সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সেন্টমার্টিন দ্বীপ এর আদি নাম ছিল নার্জিল জাজিরা বা জিঞ্জিরা। জাজিরা থেকে জিঞ্জিরা শব্দের উৎপত্তি। জিঞ্জিরা শব্দের অর্থ উপদ্বীপ, আর নার্জিল অর্থ নারিকেল। এই দ্বীপে নারিকেল গাছের আধিক্য ছিল।এখনো নারিকেল এর জন্য এই দ্বীপ জনপ্রিয়। আর এজন্যেই এই দ্বীপকে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে এই দ্বীপ এর বয়স ২০ লাখ বছর। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপের বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবি। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। কালক্রমে এই দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল।

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ ‘সেন্টমার্টিন’’ এর অবস্থান বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা কক্সবাজারের টেকনাফ থানায়। টেকনাফ থেকেও প্রায় ৯-১০ কিঃ মিঃ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এর বুকে এই দ্বীপ এর অবস্থান। আয়তনে খুব বড় নয় এই দ্বীপ, ৮ বর্গ কিঃ মিঃ, আর লোক সংখ্যা প্রায় ৭০০০-৭৫০০ এর মতন।এই দ্বীপের সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই যে ব্যাপার টি চলে আসে, সেটি হচ্ছে এখানের প্রকৃতি আর তার নির্জনতা। খুব নির্জন আর কোলাহল মুক্ত কয়েকটি দিন কাটানোর জন্য এই দ্বীপ অন্যতম, কারণ দ্বীপে কোন বাস, গাড়ি, মোটর চালিত কোন প্রকার যান নেই, এমন কি নিঝুম দ্বীপ বা কুয়াকাটার মত পাবলিক সার্ভিস দেয়ার মত মোটর বাইক ও চোখে পড়েনি। তাই অন্তত নির্জনতার মাঝে যখন কেও কোন মোহে হারিয়ে যাবে, হঠাত কোন গাড়ির হর্ন এর শব্দ এসে সব নষ্ট করে দেয়ার সম্ভাবনা একদম ই নেই এই দ্বীপে।

প্রবাল দ্বীপে শৈবাল সম্ভাবনা ‘সামুদ্রিক শৈবাল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। শৈবালেই সমুদ্রের পানির চেয়ে বেশি আয়োডিন রয়েছে, যা ওষুধ বা লবণের চেয়েও সমৃদ্ধ বিকল্প হতে পারে। বিজ্ঞানীদের দাবি সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে প্রায় দুইশ’ প্রজাতির জীবের উপস্থিতি রয়েছে। যার অধিকাংশ মানুষের খাদ্যসহ হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে। প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্যাসী শিল কাঁকড়া,লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল,রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ,উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ জায়গাটি খ্যাত।

যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় , সেন্টমার্টিন কেন যেতে চান ?  যদি বলেন সমুদ্র দেখবেন তাহলে আপনার জন্য পরামর্শ হল সমুদ্র দেখার জন্য কষ্ট করে সেন্টমার্টিন যাবার দরকার নেই। কক্সবাজার ,কুয়াকাটাতেও তো সমুদ্র দেখতে পারেন? সেন্টমার্টিন মূলত যাওয়া উচিৎ রহস্যের সন্ধানে। নির্জনতার রহস্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রহস্য আর সাগর তলের বিস্ময়কর রহস্য। সৃষ্টিকর্তা এখানকার প্রকৃতিকে দু’হাত ভরে দান করেছেন।

কিভাবে যাবেন ?

ঢাকা থেকে সরাসরি সেন্টমাটিনে যেতে চাইলে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ, ইউনিক পরিবহন এবং সেইন্ট মারটিন পরিবহণ সহ বেশ কিছু বাস সরাসরি টেকনাফ ঘাটের উদ্দেশ্যে রাত ৭ঃ৩০-৮ঃ৩০ এর মধ্যে ছেড়ে যায়। তারপর ঘাট থেকে কয়েকটি শিপ ছাড়ে সেইন্ট মারটিনের উদ্দেশ্যে সকাল ৯ঃ৩০ মিনিটে। যা দ্বীপে পৌছায় ১১ঃ৩০-১২ টার মধ্যে। এসব শিপ আবার ফিরে আসে বিকেল ৩ টার দিকে সেন্টমাটিন থেকে।

শিপ ও ক্লাস ভেদে এগুলোর ভাড়া ৫৫০ থেকে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত। তবে অফ সিজনে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) শিপগুলো চলে না, এই সময়টাতে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার একমাত্র উপায় হল ট্রলার।

আর কেউ যদি কক্সবাজার থেকে যান, তাহলে সকালে টেকনাফের উদ্দেশ্যে বাস, মাইক্রো, চান্দের গাড়ি ছাড়ে। অনেক প্যাকেজ অফার ও থাকে । 

কক্সবাজার থেকে গেলে প্যাকেজ নিয়ে যাওয়াই ভালো। কক্সবাজারে যে হোটেলে থাকবেন, তাদের কাছে বললে তারা ব্যবস্থা করে দিবে। তবে তাদের কাছে শুধু ট্রান্সপোর্ট এর সুবিধা ও আলাদা করে নেয়া যায়। এর সুবিধা হল খুব ভোরে উঠে টেকনাফ যাওয়ার জন্য বা শিপের টিকেটের জন্য আলাদা করে দৌড় ঝাঁপ করতে হবে না। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ, শিপের রিটার্ন টিকেট(সেন্ট মার্টিন যাওয়া এবং আসা) এবং আবার টেকনাফ থেকে কক্সবাজার নিয়ে আসা সব মিলিয়ে খরচ হয় ১০০০-২০০০ টাকা (শিপের ক্লাস ভেদে খরচ বাড়ে-কমে)।

আপনি ফিরে আসতে চাইলে সেন্টমার্টিন হতে টেকনাফ অথবা কক্সবাজার বাস টার্মিনালে আসে আপনার গন্তব্যে ফিরে আসতে পারবেন। 

কি খাবেন ? 

এই দ্বীপের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস হল ডাব। এই দ্বীপের নাম নারিকেল জিঞ্জিরা এমনি এমনি হয়নি। এখানকার ডাবের পানি যেমন মিষ্টি তেমনি সুস্বাদু। সেন্ট মারটিনে গেলে ডাবের পানি মিস করা ঠিক হবে না। যারা মাছ খান না আমার মতে তাদের সেন্ট মার্টিন যাওয়ার অধিকারই নেই। কারন কোরাল,সুন্দরী পোয়া,ইলিশ, রূপচাঁদা,লবস্টার,কালাচাঁদার স্বাদ এক কথায় অসাধারণ। আর একটা জিনিস অবশ্য খেয়ে দেখতে পারেন। সেটা হল কুরা (স্থানীয় ভাসায় দেশী মুরগিকে বলা হয় কুরা)। শুঁটকি মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে লইট্টা, ছুড়ি, রূপচাঁদা, কাচকি ট্রাই করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন বেশির ভাগ শুঁটকি কিন্তু আসে কক্সবাজার ও চট্ট্রগ্রাম থেকে। যারা ইলিশ খুব বেশি পছন্দ করেন তারা জেনে রাখুন সমুদ্রের ইলিশ নদীর ইলিশের মত টেস্টি নয়।

আরেকটি কথা,যারা জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারীতে সেন্ট মারটিন যাবেন তারা অবশ্যই তরমুজ মিস করবেন না। দেখতে খুব একটা লাল না হলেও খেতে কিন্তু বেশ।

কোথায় থাকবেন ?

সেন্ট মার্টিনে হোটেল বা রিসোর্ট বুকিং এর ক্ষেত্রে একটু সাবধানী সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী। এখানে মনের মত সুযোগ সুবিধা দেয় এমন একটিও হোটেল/ রিসোর্ট এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর মূল কারন হল বিদ্যুৎ। ১৯৯১ এর আগে সেন্টমার্টিনে সীমিত আকারে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা থাকলেও ১৯৯১ এর প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সব লন্ড ভন্ড হয়ে যায়। এর পরে সেন্ট মার্টিন আর সরকারী ব্যবস্থায় বিদ্যুতের মুখ দেখেনি। তাই হোটেল/ রিসোর্ট গুলো নিজস্ব জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থেকে। এর ফলে বিদ্যুৎ রিলেটেড সুবিধাগুলো (ফ্রিজ, রুমে এসি, ২৪ ঘণ্টা ফ্যান)পাওয়া যায় না । হোটেল/ রিসোর্ট বুকিং এর ক্ষেত্রে কে কতটুকু সুযোগ সুবিধা দেবে তা নিশ্চিত হয়ে নিন। সেন্টমার্টিন উপভোগ করতে চাইলে পশ্চিম বীচের হোটেল/ রিসোর্টের বিকল্প নেই। তাই পশ্চিম পাড়ের রিসোর্টগুলোকে টার্গেট করতে পারেন। তবে যারা হইহুল্লর পছন্দ করেন তারা বাজারের কাছাকাছি হোটেলগুলোতে থাকুন। হোটেল/ রিসোর্ট বুকিং এর ক্ষেত্রে আপনারা চাইলে সেখানে গিয়েও খুঁজে নিতে পারেন। এতে সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। হোটেল খুঁজতে খুঁজতে আপনার যেটুকু সময় নষ্ট হবে আর যে ধকল যাবে তাতে তবে দরদাম করে হোটেল ভাড়া কিছুটা কমাতে পারেন । আর একটি বিষয় হল বিশেষ ছুটির দিন (১৬ ডিসেম্বর,২৫ ডিসেম্বর,৩১ ডিসেম্বর,২১ ফেব্রুয়ারী,২৬ মার্চ সহ অন্য তিন দিনের টানা বন্ধ) গুলোতে কোন প্রকার হোটেল / রিসোর্ট পাওয়াই কষ্টকর হয়ে যায়। তাই এসময়গুলোতে আগে থেকেই হোটেল / রিসোর্ট বুক করে নিশ্চিত করে রাখবেন।

কি কি করার আছে ? 

  • সাইকেল চালানো।
  • হেঁটে/ স্পিডবোট/ মাছ ধরার ট্রলার/ লাইফবোটে/ সাইকেলে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া।
  • নানা ধরনের মাছের বার-বি-কিউ খাওয়া।
  • খুব ভোরে উঠে জেলেদের কাছ থেকে মাছ কেনা।
  • বিকেলে জেলেদের সঙ্গে জাল টেনে মাছ ধরা (ভাগ্য ভালো হলে ফ্রি মাছও পেয়ে যেতে পারেন)
  • ক্যাম্প ফায়ার করা।
  • স্কুবা ড্রাইভিং করা।
  • ফানুশ/ফ্লেয়ার উড়ানো।
  • সূর্যাস্ত দেখা। আর রাতে সমুদ্রের গর্জন শোনা।

কি কি খাওয়ার আছে ?

মাছের বারবিকিউ (বাজারে সব হোটেলেই মাছ সাজিয়ে রাখা হয় যেটা বলবেন বার-বি-কিউ করে দিবে) দরদাম করে নিবেন। জেটি থেকে বাজারের রাস্তা ধরে শেষ মাথায় হাতের বামে পেঁয়াজু, সিঙ্গারা, সমুচার দোকান আছে। ওদের পেয়াজু সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় তাই আগে আগে যাবেন। চিংড়ি, ক্র্যাব ফ্রাইও খেতে পারেন।

ছেঁড়া দ্বীপ হেঁটে যেতে দেড় থেকে দুই ঘন্টা লাগে যদি পশ্চিম বিচ ধরে যান। তবে একটু কষ্টকর এই অভিযান। কিন্তু যাওয়াটা বৃথা হবে না। আরামে এবং দ্রুত যেতে চাইলে পূর্ব বিচ ধরে যাবেন। জোয়ারের সময় পরিবর্তন হয়। তাই যেদিন যাবেন স্থানীয় লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করে নিবেন। হেঁটে যেতে পশ্চিম বিচ দিয়ে যাবেন এবং পূর্ব বিচ দিয়ে আসবেন তাহলে অনেক কিছু দেখতে পাবেন।

যারা দিনে গিয়ে দিনেই সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে আসবেন তারা পরবর্তীতে আফসোস করতে পারেন তাই সবচেয়ে ভালো হয় অন্তত একদিন সেন্টমার্টিনে অবস্থান করা। এতে যেমন পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে পারবেন তেমনি এই আনন্দময় ভ্রমণ আপনাকে সব সময় মোহিত করবে।

সাম্প্রতিক